শুন্য অভিকর্ষ ভ্রমনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা

এফ. আর. সরকার

বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির উদ্দ্যোগে ২০০৩ সন থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত এবং বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহ সংস্থা কর্তৃক সমন্বয়কৃত “বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহ” প্রতি বৎসর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে নিয়মিত উদ্যাপন করা হচ্ছে। এর মূল অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে যেখানে এলাকার বিভিন্ন স্কুল থেকে আগত হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এতে অংশগ্রহন করে এক মহাকাশ মেলার আবহ সৃষ্টি করে।

২০০৬ সনের জুন মাসে বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহ্ সংস্থা বা World Space Week Association -এর প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে অবস্থিত United Nation Office for Outer Space Affairs (UNOOSA) কর্তৃক আয়োজিত মহাকাশ বিষয়ক সেমিনারে আমার যোগদান করার সুযোগ হয়েছিল। যেহেতু বাংলাদেশ এই UNOOSA -এর সদস্যপদ লাভ করেনি তবুও সেখানে ২০০৫ সনে অক্টোবরে এনায়েতপুরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহ্ বা World Space Week-2005 এর একটি ভিডিও ঐ অধিবেশনে প্রদর্শন করার অনুমতি লাভ করি। এটি প্রদর্শনের পর বিভিন্ন দেশ ও মহাকাশ সংস্থা থেকে আগত প্রতিনিধিগন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহ্ পালনের দৃশ্য দেখে তুমুল করতালী দিয়ে অভিনন্দন জানান। এখানে উপস্থিত World Space Week Association এর প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA র একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মি. ডেনিস স্টোন তার বক্তৃতায় বলেন যে বাংলাদেশ একটি অনুন্নত দেশ, যেখানে মহাকাশ শিক্ষা করার কোন সুযোগ নেই অথচ সেই দেশের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা মহাকাশ বিষয় সম্পর্কে কত উৎসাহী এর জন্য আসুন আমরা বাংলাদেশকে স্যালুট করি। আবার অধিবেশনে করতালীর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রশংসায় উপস্থিত প্রতিনিধিগন তাদের প্রতিক্রিয়া জানালেন। এতে একটি বিষয় পরিস্কার হলো যে বাংলাদেশে যদিও মহাকাশ শিক্ষা ও গবেষণা করার কোন সুযোগ নেই কিন্তু সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা মহাকাশ বিষয়ে অসম্ভব উৎসাহী যার নিদর্শন পৃথিবীর আর কোন দেশে  নেই।

এর কিছুদিন পর World Space Week Association এর প্রেসিডেন্ট মি. ডেনিস স্টোন আমাকে জানালেন World Space Week-2007 উপলক্ষে Zero-Gravity Flight এর জন্য উদ্দ্যোগ নেওয় হয়েছে আর সেখানে বাংলাদেশ থেকে একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে অংশগ্রহন করার জন্য সুযোগ দেওয়া হবে। তাছাড়া এই Flight এর জন্য যত ব্যয় হবে তার সমস্ত টাকা World Space Week Association এর পক্ষ থেকে বহন করা হবে, শুধু ছাত্র/ছাত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য খরচ বহন করতে হবে। এখানে একটি শর্ত আছে তাহলো ঐ ছাত্র বা ছাত্রীকে খুব মেধাবী হতে হবে এবং অবশ্যই খুব দরিদ্র হতে হবে।

এই সুযোগের খবর পাওয়ার পর দৈনিক প্রথম আলোর “বিজ্ঞান প্রজন্ম” পাতার প্রধান মুনীর হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মুনীর হাসান এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য কাজ করার সম্মতি প্রদান করলেন এবং প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নির্বাচিত ছাত্র বা ছাত্রীটির যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য প্লেন ভাড়া ও অন্যান্য খরচের জন্য স্পন্সর করারও ব্যবস্থা করলেন। এর পর প্রথম আলো পত্রিকা থেকে প্রার্থী মননয়নের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো এবং অবশেষে কুমারখালীর রফিকুল নামে একজন ছাত্রকে নির্বাচিত করা হলো। ২০০৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ছাত্র হিসাবে রফিকুল ও তার গার্ডিয়ান হিসেবে মুনীর হাসান বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করার পর মুনীর হাসানকে ভিসা দেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করা হলো কিন্তু রফিকুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান হলো এই জন্য যে, যেহেতু সে গরীব ঘরের সন্তান সুতরাং যদি একবার যুক্তারাষ্ট্রে ঢোকে তবে সে আর বাংলাদেশে ফেরৎ আসবেনা। ফলে এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পরিণত হলো। এদিকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে একজন ছাত্রকে বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে শুণ্য অভিকর্ষ ভ্রমন বা Zero-Gravity Flight এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। এমন কি দৈনিক ইত্তেফাকে খুব সম্ভব ২০০৭ সনের ৪ঠা অক্টোবর একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল তাতে লেখা হয়েছিল আজ বাংলাদেশের একজন ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে শুন্য অভিকর্ষ ভ্রমনে অংশগ্রহন করছে।

যেহেতু বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সংবাদের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ থেকে একজন ছাত্র যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে শুন্য অভিকর্ষ ভ্রমন করার ব্যপারে বিশ্বাস করে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিষয়টি বাস্তবে পরিণত হলোনা আর এতে অনেকের মনে আমাদের সোসাইটি সম্পর্কে খারাপ ধারনা হতে পারে – এই ভুল ভাঙ্গার জন্যই বলা চলে আমি ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগ নিয়েছিলাম যে আমিই শুন্য অভিকর্ষ ভ্রমনে অংশগ্রহন করবো, অন্তত এতে বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সংবাদ যে সঠিক ছিল সে সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমগুলোর ভ্রান্ত ধারনার অবসান ঘটবে।

এর পর পরই আমি যুক্তরাষ্ট্রের Space Adventure Corporaton এর সঙ্গে যোগাযোগ করেলাম যাদের Zero –G Plane দিয়ে ব্যবসায়ীকভাবে শূন্য অভিকর্ষ ভ্রমনের ব্যবস্থা করা হয়। আগে ঐ প্লেনটি নাসার এ্যাস্ট্রোনটদের ট্রেইনিং এর জন্য ব্যবহার করা হতো বর্তমানে Space Adventure এটি কিনে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। প্রতি ফ্লাইটের জন্য প্রত্যেক যাত্রীকে ৪২০০ মার্কিন ডলার ভাড়া দিতে হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেনেডি স্পেস সেন্টার, নেভাদার, লাস ভেগাস থেকে মাসের নির্ধারিত দিনগুলোতে উড্ডয়নের ব্যবস্থা করা হয়। তবে নির্দ্দিষ্ট তারিখে বা সময়ে এটি উড্ডয়ন হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। আকাশে মেঘের অবস্থা এবং বায়ুপ্রবাহের গতির উপর এটি নির্ভরশীল সেই ধরনের পরিবেশ যতক্ষন পর্যন্ত নিশ্চিত না হওয়া যায় ততক্ষন পর্যন্ত এই প্লেনটি উড্ডয়ন করা হয় না। কারন এই প্লেনটি ৩২,০০০ ফিট উচ্চতায় উঠে কিছুক্ষন সমান্তরালভাবে চলতে থাকে তার পর একটি প্যারাবোলিক ডাইভের জন্য, আর ১০,০০০ ফিট উপরে উঠে ডাইভ শুরু করে এবং যখন উপর থেকে নিচের দিকে ১০ হাজার ফিট নামা শুরু হয় ঠিক ঐ ৩০ সেকেন্ডের মত সময় ভিতরে যে সব যাত্রী থাকেন তারা শুন্য অভিকর্ষ অনুভব করেন এবং পাখীর মত ভাসতে থাকেন।

২০০৮ সনের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে আমি যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়ার রিজক্রেস্ট নামক এক শহরে আমার মেয়ের বাড়িতে চলে গেলাম। স্পেস এ্যাডভেঞ্চার কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফ্লাইট বুকিং দিলাম। কম পক্ষে ১ মাস সময় অপেক্ষা করতে হবে, মোটামুটি ধারনা করা গেল মে মাসের শেষের দিকে এই ফ্লাইটের সুযোগ পাওয়া যাবে। আমি নেভাদার লাসভেগাস শহর থেকে ফ্লাইট করার জন্য আবেদন করেছিলাম এবং সিডিউল সেইভাবে ঠিক করা হলো।

কয়েক সপ্তাহ্ পরে Space Adventure Corporation থেকে আমাকে জানানো হলো যে, মে মাসের ২৪ তারিখে সকাল ৮ টার দিকে লাস ভেগাসে ওদের অফিসে উপস্থিত হতে হবে হয়তো ঐ দিনই Zero-Gravity Flight ফ্লাইট সম্ভব হতে পারে। ২৩ শে মে আমরা রিজক্রেস্ট থেকে লাস ভেগাসে এলাম সঙ্গে আমার স্ত্রী, মেয়ে, জামাতা এবং তার ছেলে ও মেয়ে। সন্ধ্যার কিছুপর লাস ভেগাসে পৌছলাম এবং ওখানে আমার জামাতার মামার বাড়ীতে উঠলাম। আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল রাতে খুব হালকা আহার করতে এবং ভালভাবে ঘুমতে কিন্তু জিরো গ্রাভিটি ফ্লাইট করার বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে চিন্তা ভাবনা আর এক ধরনের মানসিক উত্তেজনার জন্য রাতে তেমন ঘুম হলোনা।

সকালে নির্দ্দিষ্ট সময়ে Space Adventure Corporation এর অফিসে পৌছলাম। সেখানে কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর Orientation Class এ যোগদান করা হলো। ওখানে আমার মত প্রায় ২৭ জনের মত যাত্রী। প্যারাবলিক ফ্লাইটের সময় প্লেনের ভিতর কিভাবে শুয়ে থাকতে হবে এর পর শুন্য অভিকর্ষের সময় কিভাবে ভাসতে হবে বা যদি শরীরে কোন অসুস্থতা মনে হয় তাহলে কি কি করনীয় এসব ব্যাপারে প্রায় ঘন্টা খানেক ভিডিওর মাধ্যমে প্রশিক্ষন দেওয়া হলো। আগেই আমাদেরকে Uniform পড়ানো হয়েছিল, প্রত্যেকের বুক পকেটের উপর নাম সম্মলিত ব্যাজ লাগানো হলো এবং এক সময় চিফ ট্রেইনার বলে উঠলেন “Now go ahead”। আমরা সকল যাত্রী মিলে বিল্ডিং এর পাশে রাখা একটি বাসে উঠলাম এবং মিনিট দশেকের মধ্যেই বাসটি ম্যাক ক্যারান এ্যায়ারপোর্টের ভিতর ঢুকে গেল এবং একটু দুরেই দেখা Boeing 727, Zero-G Plane টি দাড়িয়ে আছে।

Zero G1

বাস থেকে নামার পর আমাদেরকে এক জায়গায় লাইন দিয়ে দাড় করানো হলো সেখানে Instructor আমাদেরকে আরও কিছু মূল্যবান তথ্য দিলেন যাতে আমরা শুন্য অভিকর্ষের সময় খুব উত্তেজিত না হই বা চিৎকার না করি। এরপর আমাদেরকে ৩ টি গ্রুপে ভাগ করা হলো প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একজন করে ট্রেইনার, সেখানেও ট্রেইনার আমাদেরকে অনেক করণীয় বিষয়ে অভিহিত করলেন। অবশেষে আমরা এক একজন করে প্লেনে উঠতে শুরু করলাম। সাধারনত্ প্লেনের পাশে দরজা থাকে কিন্তু এই প্লেনে কোন দরজা নেই শুধু জানালা আছে, আমরা সিড়ি বেয়ে প্লেনের পিছনের দিকে নিচ থেকে এর মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

প্লেনটির পিছনের দিকে কিছু বসার সিট আর সম্মুখে পাইলটের কেবিনের দেয়াল পর্যন্ত সম্পূর্ণ ফাকা। ফ্লোরে মোটা ফেমের গদি দেওয়া। একটু পরেই প্লেনটি টেক অফ করলো। প্রায় ঘন্টা খানেক চলার পর ক্যালিফোর্ণিয়ার মোহাবী ডের্জাট এলাকায় চলে এলো, এখানে ফ্লাইট জ্যাম নেই। এখানে আসার পর আমাদের গ্রুপ লিডারের সঙ্গে তিনটি ভাগে একটু পর পর ফোমের উপর শুয়ে পড়লাম। একটু পরেই প্যারাবোলিক ফ্লাইটের আপটার্ন শুরু হলো। ভীষন চাপ অনুভব করলাম, চাপের চোটে শরীর একাত ওকাত করতে পারছিলামনা। এর পর ডাউন টার্ন শুরু হলো। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমরা সকলেই পাখীর মত ভাসছি অনেকের সঙ্গে এদিকে ওদিকে উড়ে বেড়ালাম, অনেক এ্যাক্রোবাইটের মত কসরত করতে থাকলো। এইটি হলো Zero-Gravity বা শুন্য অভিকর্ষের সময়। যদিও ইন্স্ট্রাকটর আমাদেরকে চিৎকার করতে বারণ করেছিলেন কিন্তু দেখলাম অনেকেই উত্তেজনার অতিসয্যে চিৎকার শুরু করছে।

Zero G2

বস্তুত একটা প্যারাবোলিক ৬০ সেকেন্ডের মত স্থিতি ছিল এর মধ্যে আমরা ৩০ সেকেন্ড পেতাম শুন্য অভিকর্ষের আনন্দ উপভোগ করার জন্য। শুন্য অভিকর্ষ শেষ হওয়ার কিছুক্ষন আগে আমাদের ইনস্ট্রাক্টর হ্যান্ড মাইক দিয়ে বলে দিতেন শেষ হয়ে যাচ্ছে ফ্লোরে শুয়ে পড়। অনেকে যারা এ আদেশ মানতো না তারা ধপাস করে ফ্লোরের উপর পড়ে যেত। অবশ্য এতে ভয়ের কোন কারণ ছিল না কারন এত মোটা ফোম দিয়ে প্লেনের ফ্লোর কভার করা ছিল যে ধপাস করে পড়ে গেলেও তেমন কোন ব্যাথা পাওয়া যেত না। আমাদের সঙ্গে ক্যামেরাম্যান ছিল সেও শুন্য অভিকর্ষে ভেসেই ছবি তুলতো সেই ছবি একটুও ডিস্টর্ট হতো না। আমাদের মোট ১৫ টি প্যারাবোলা হয়েছিল এর মধ্যে ১৩ টি জিরো বা শুন্য অভিকর্ষের। এছাড়া একটি ছিল ১/৬ অভিকর্ষ অর্থাৎ চন্দ্রপৃষ্ঠে ৬০ কেজি মানুষের ওজন হবে ১০ কেজি আর একটি ছিল ১/৩ অভিকর্ষ অর্থাৎ মঙ্গল পৃষ্ঠে একজন ৬০ কেজি মানুষের ওজন হবে ২০ কেজি।

বস্তুত শুন্য অভিকর্ষ সময়গুলোর মধ্যে আমি উড়াল দেওয়ার চেয়ে কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষায় ব্যস্ত থেকেছি। যেমন একটি প্লাস্টিক টিউবের মধ্যে পানি নিয়ে গিয়েছিলাম, শুন্য অভিকর্ষের সময় দেখা গেল পানি বের হচ্ছেনা মুখ দিয়ে টানতে বুদবুদ হয়ে উড়ে গেল। এরপর একটি ছোট কাগজের টুকরা ও ২৫ সেন্টের কয়েন শুন্য অভিকর্ষের সময় ছেড়ে দিলাম দেখা গেল, দুটো বস্তু একই সমান্তরালে ভাসছে বা অবস্থান করছে। আমার তখন মনে পড়ছিল স্যার আইজ্যাক নিউটন ৪০০ বছর আগে কেমন করে বুঝতে পেরেছিলেন শুন্য অভিকর্ষে কোন কিছুরই ওজন থাকেনা। কিছু লজেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম লজেন্সগুলো শুন্য অভিকর্ষের সময় ছেড়ে দিলে ভেসে থাকে এবং পাখীর মত এইগুলোকে গলাধকরন করতে খুবই উত্তেজনাপ্রদ মনে হয়। দেখলাম অনেকেই পাখীর মত লজেন্স মুখ দিয়ে খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করছেন।

আমাদের ফ্লাইটের মোট সময় ছিল ৩ ঘন্টার মত। এর মধ্যে ১ ঘন্টার মত চলেছে প্যারাবোলিক সিমুলেশন। এই সিমুলেশনের আনন্দ যে কত রোমাঞ্চকর তা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো সম্ভব না। ফ্লাইট শেষে আমরা যখন একত্রিত হলাম তখন এক একজন এক এক রকম অভিজ্ঞতার কথা বলছে এবং আনন্দে আতœহারা হচ্ছে। যদিও এটা কোন মহাকাশ ভ্রমন ছিলনা তবুও মহাকাশ ভ্রমনকারীরা শুন্য অভিকর্ষে কি ধরনের অনুভূতি অনুভব করে তার কিছু জ্ঞান আহরন করা গেল।

আর একটি বিষয় লক্ষ করা গেল তাহলো আমরা যখন শুন্য অভিকর্ষের সময় ভাসছিলাম তখন একে অন্যের গায়ে ধাক্কা লাগছিল কিন্তু কোন ব্যাথা তো দূরের কথা কিছুই মনে হচ্ছিল না। পা উপরে, মাথা নিচে অবস্থায় কোন খারাপ লাগছিলনা বরং এক ধরনের অন্যরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি অনুভব করছিলাম।

আমাদের সঙ্গে কিছু বয়স্ক যাত্রী অংশগ্রহন করেছিলেন অবশ্য এখানে বয়স কোন ফ্যাক্টর নয়। কিছুদিন আগে চন্দ্র বিজয়ী দ্বিতীয় ব্যক্তি বাজ আলড্রিন এবং প্রখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ বিজ্ঞানী ড. স্টিফেন হকিং এই প্লেনে শুন্য অভিকর্ষ উপভোগ করতে অংশগ্রহন করেছিলেন। বাজ আলড্রিন বহুবার মহাকাশযানে ভ্রমন করেছেন তবুও কেন তিনি এখানে এসেছিলেন। এর একটি কারণ হলো শুন্য অভিকর্ষে যারা একবার ভ্রমন করেন তারা এই রোমাঞ্চকর অনুভূতি অনুভব করার জন্য বার বার ভ্রমন করতে আসেন। সত্যি কথা বলতে কি আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় আর একবার যদি সুযোগ হয় তবে আবারও শুন্য অভিকর্ষ ভ্রমনে অংশগ্রহন করবো।

ম্যাক ক্যারান এয়ারপোর্টে ফিরে সোজা আমাদেরকে স্পেস এ্যাডভেঞ্চার অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে সকলকে খাবার ও একটা করে শুন্য অভিকর্ষে থাকার সময়কার ধারণকৃত ছবির ফ্রেম, ইউনিফর্ম ও কিছু উপহার সামগ্রী দেওয়া হলো। এর পর অফিসের বাইরে এসে দেখি আমার স্ত্রী, মেয়ে, জামাতা, নাতি, নাতনী হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। শুন্য অভিকর্ষের মত একটা নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে এলাম বলে তারাও খুব আনন্দিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *