এফ, আর, সরকার
এক সময় মানুষ ভাবতো এই পৃথিবীতে যা আছে তাই মানুষের জীবন ধারনের জন্য যথেষ্ট, পৃথিবীর উপরে দেব দেবতাদের বসবাস, এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ও প্রয়োগ বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে এমন সব তথ্য ও উপাত্তের সন্ধান পাওয়া গেল যে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে গবেষনার পরিধি সীমিত হয়ে আসছে এখন মহাকাশ গবেষনা অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে। আসলে তাই, কেননা বর্তমান প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে দেখতে পারবো মানুষ নামে প্রজাতির জীবন যাপনের জন্য মহাকাশ প্রযুক্তির প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা যে মোবাইলে কথা বার্তা বলছি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করছি বা টেলিভিশনে অনুষ্ঠানগুলো দেখছি সব কিছু এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যেগুলো পৃথিবী থেকে ২২,৪০০ মাইল উপর থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করছে। এগুলোকে জিওস্টেশনারী স্যাটেলাইট বলা হয় অর্থাৎ পৃথিবী তার অক্ষের উপর যে গতিতে ঘুরছে, এই স্যাটেলাইটগুলোও ঠিক একই গতিতে ঘুরছে, ফলে এগুলোর অবস্থান একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে বলে মনে হয়। অন্যদিকে পৃথিবীর আবহাওয়া, সমুদ্রে সাইক্লোন, নদীতে ভাঙ্গন, পানির স্রোতর গতি বিধি মেঘের গতিবিধি, বৃষ্টি ও ঝড়-ঝাপটার পূর্বাবাস এমনকি সমুদ্রের কোন জায়গায় মাছের ঝাক আছে বা পৃথিবীর কোন ক্ষেত্রের উর্ব্বরতা কতটুকুন এবং সেখানে কোন ফসল বুনলে বেশী ফলন হবে এসব কিছুই আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইটর সাহায্যে নির্ণয় করা হয়। এই আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর ২০০ মাইল থেকে ৪০০ মাইল উপর দিয়ে প্রদক্ষিন করছে।
এরপর আরও এক ধরনের স্যাটেলাইট আছে যে গুলোকে বলা হয় গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জি.পি.এস.। এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শুধু পৃথিবীর ম্যাপই নয় রাস্তা-ঘাট এমনকি কোন নির্দ্দিষ্ট বাড়ীর অবস্থান এিমাত্রিকভাবে পর্যন্ত জানা যায়। এমনকি একটি নির্দিষ্ট নম্বরের মোবাইল ফোন দিয়ে কেউ কথা বলছে, তার অবস্থান কোথায় তা পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়। জি.পি.এস. স্যাটেলাইটের ব্যবহার এখন আমাদের দৈনিন্দিন জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এর কিট্ গাড়ীতে লাগিয়ে নিলে আর ড্যাস বোর্ডের হুইল ঘুরাতে হবে না, গাড়ী একাই নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে একটি গাড়ী বা যানবাহন কোথায় আছে তাও এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানা সম্ভব হবে।
আমাদের পৃথিবীর চারদিক দিয়ে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজারের মত বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট প্রদক্ষিন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা থেকে নিয়মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করা হচ্ছে, একটি নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এগুলো কার্যক্ষম থাকে তারপর বিকল হয়ে পড়ে তখন এগুলোকে সমুদ্রে ও লোকজনহীন এলাকায় পতন ঘটানো হয়। দিন দিন স্যাটেলাইটের প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলেছে এবং মানুষের প্রত্যেকটি কর্মক্ষেত্রে এক সময় এর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে দাড়াবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত ঘন জনবহুল দেশে এর প্রয়োজনীয়তা প্রকট হয়ে দাড়াবে। উদাহরন সরূপ, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধরা যাক। যেভাবে মানূষ বাড়ছে, বাড়ীঘর হচ্ছে কিন্তু সে পরিমানে স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি স্থাপন করার মত বড় জায়গা পাওয়া যাচ্ছেনা আর ভবিষ্যতে তা আরও পাওয়া যাবে না। এখনই সেশন জট শিক্ষাঙ্গনে বিরাট বাধা হয়ে দাড়িয়েছে, ভবিষ্যতে এটি আরও ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করবে। সুতরাং এর একটি একটিমাত্র বিকল্প পথ আছে তাহলো টেলিএডুকেশন সিস্টেম প্রবর্তন করা। পৃথিবীর বহু দেশেই এখন টেলিএডুকেশন সিস্টেম চালু করেছে। এতে সুবিধা হলো ছাত্রকে আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় না। বাড়ীতে বসেই কম্পিউটারের মাধ্যমে সে শিক্ষা লাভ করতে পারে, শুধু কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়।
এর সঙ্গে আরও একটি প্রযুক্তি এখন বিশ্বব্যাপী প্রয়োগ শুরু হয়েছে যা বাংলাদেশের জন্যও অপরিহার্য তাহলো টেলিমেডিসিন। রুগীকে এখন আর হাসপাতালে গিয়ে লাইন ধরে প্রচুর অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। একটি নির্দিষ্ট রুমের মধ্যে দাড়ালেই মনিটরে ডাক্তারকে দেখা যাবে, ব্লাড প্রেসার, থার্মমিটার থেকে শুরু করে এক্সরে, রেডিওলজি, হেমাটোলজি ইত্যাদি সব পরীক্ষা নীরিক্ষা হবে এবং ডাক্তার প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিবেন। এই টেলিমেডিসিন সিস্টেমের মাধ্যমে রুগীদেরকে ভবিষ্যতে সিংগাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে যেতে হবে না, বাংলাদেশ থেকেই ঐ হাসপাতালের ডাক্তারদের দ্বারা চিকিৎসা করানো যাবে আর তাতে খরচও পড়বে অনেক কম। শুধু তাই নয় পৃথিবীর যে কোন উন্নত হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ থাকবে। আবার বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা দেওয়ারও সুযোগ তৈরি হবে।
কিন্তু এই টেলিএডুকেশন ও টেলিমেডিসিন এর ব্যবস্থা করতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হবে স্যাটেলাইটের সাহায্য যা বাংলাদেশে নেই। সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষনার জন্য সরকারীভাবে তেমন কোন বাস্তব উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৮০ সনে Space Research and Remote Sensing Organisation (SPARRSO)গঠন করা হলেও স্পেস রিসার্সের কোন কাজ এখানে করা হয় না। বস্তুত এটি একটি রিমোট সেন্সিং অরগানাইজেশন যাদের কাজ হলো আবহাওয়া সম্পর্কে সতর্ক করা আর কিছু ম্যাপ তৈরি করা। এই প্রতিষ্ঠানে মহাকাশ শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই আর যেখানে মহাকাশ শিক্ষার কোন ব্যবস্থাই নেই তাহলে একে দিয়ে মহাকাশ গবেষনার কি লাভ হবে? একসময় স্পারসো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের অধীনে ছিল কিন্তু পরে একে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ফলে এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রমে অনেক লালফিতার জটিলতায় আবদ্ধ। তাছাড়া এখানে যারা প্রধান হয়ে আসেন তাদের অনেকেই বিজ্ঞানের উপর পড়াশুনা করেননি ফলে বিজ্ঞান বহির্ভূত জ্ঞান নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানের মত জটিল বিষয় পরিচালনা করা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে।
দুঃখজনক হলেও একটি কথা অতি সত্য তাহলো বিজ্ঞান গবেষনাকে বাংলাদেশের সরকার প্রধানরা মোটেই আগ্রহের সঙ্গে দেখেননা। কোন দেশেই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষ করে সরকার প্রধানদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বিজ্ঞান গবেষনার কোন উন্œতি হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি যদি চন্দ্রে মানুষ অবতরনের জন্য সেদেশের মহাকাশ সংস্থা “নাসা” কে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ প্রদান না করতেন তা হলে হয়তো এ্যাপোলো লুনার মিশনও সফল হতো না, আর নেইল আর্মষ্ট্রং সহ অন্যান্য ১২ জন নভোচারীদের চন্দ্র অবতরন সম্ভব হতো না। তেমনিভাবে যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু যদি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা না যোগাতেন তাহলে বিশ্বের তৃতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্স অর্গানাইজেশনের জন্মও হতো না আর তারা চাঁদের বুকে চন্দ্রযান-১ পাঠাতেও পারতেন না।
বস্তুত বাংলাদেশে মহাকাশ বিষয়কে জনপ্রিয়করনের জন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অবদান সবচেয়ে বেশী। বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি ২০০৩ সন থেকে দীর্ঘ ১০ বৎসর যাবৎ জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহ্ নিয়মিতভাবে উদ্যাপন করে আসছে। এর মূল অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর নামক একটি গ্রামে। প্রতি বৎসর অক্টোবরের প্রথম সপ্তা্হে দু-দিন ব্যাপী এই মহাকাশ অনুষ্ঠানে মহাকাশ বিষয়ক চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, ওয়াটার রকেট প্রতিযোগিতা, মহাকাশ বিষয়ক বক্তৃতা, প্রশ্নোত্তর, নাটক, নৃত্য পরিবেশন করা হয়। দেশের গন্যমান্য বিজ্ঞানীরা এখানে এসে তাদের মহাকাশ সম্পর্কে জ্ঞান গর্ভ বক্তৃতা প্রদান করেন। অত্র এলাকার বিভিন্ন স্কুল থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিশাল মিছিল সহকারে এই অনুষ্ঠানে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহন করে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর কোন দেশে মহাকাশ নিয়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এত বিশাল আয়োজন আর কোন জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় না। আর বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষনার কোন সরকারী সহযোগিতা নাথাকলে বেসরকারীভাবে মহাকাশ বিষয়ে উৎসাহ উদ্দিপণার দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। ২০১১ সনের বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহে জাতিসংঘ দু’জন প্রতিনিধি পাঠিয়ে ছিলেন এনায়েতপুরে এবং UNOOSA, UNESCO I Bangladesh Astronomical Society (BAS)-এর যৌথ উদ্দ্যোগে মহাকাশ সপ্তাহ্ পালন করা হয় যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। ২০১১ সনের জানুয়ারী মাসে, এনায়েতপুরে মহাকাশ সংস্থা JAXA, UNESCO এবং বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির যৌথ উদ্দ্যোগে “APRSAF Space Education Seminar” করা হয় যাতে জাপান থেকে ৫ জন এবং ইউনেস্কোর হেড অফিস প্যারিস থেকে একজন কর্মকর্তা এতে অংশগ্রহন করেন।
২০০৬ সন থেকে বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি “Asia-Pacific Regional Space Agency Forum (APRSAF) এর বাৎসরিক অধিবেশনে নিয়মিত অংশগ্রহন করে আসছে। এ পর্যন্ত ওয়াটার রকেট প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন তরুন, ‘ব্যাঙ্গালুরু, হ্যানয়, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত APRSAF অধিবেশনে ওয়াটার রকেট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে দেশের জন্য সুনাম অর্জন করেছে। এখানে উল্লেখ্য বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি ২০০৭ সনে বাংলাদেশে প্রথম ‘ওয়াটার রকেট’ উদভাবন করে এবং একই বৎসর এনায়েতপুরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহে তা উৎক্ষেপন শুরু করা হয়।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১২ সনে চন্দ্রপৃষ্ঠে পরিবহনের জন্য Lunarobotic (Chondrobot)রোভার তৈরি করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারে গিয়ে এটি প্রদর্শন করে বাংলাদেশের সুনাম অর্জন করে।
অন্যদিকে BUET থেকেও Rover বানানোর জন্য উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং শিঘ্রই NASA তে এটি প্রদর্শন করা হবে। তাছাড়া অন্যান্য বেসরকারী সংস্থা জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করনের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, এদের মধ্যে, অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞান চক্র, বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন, বিজ্ঞান জনপ্রিয়করন সমিতি, ডিসকাশন প্রজেক্ট ইত্যাদি।
বর্তমান বিশ্বে মহাকাশ প্রযুক্তির যে ব্যাপক বিকাশ ও কার্যক্রম শুরু হয়েছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি চলতে না পারা যায় তবে অচিরেই বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অনগ্রসর জাতি হিসেবে পরিগনিত হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি অর্জন করেছে এবং মহাকাশ গবেষণা পরিচালনার জন্য যে ধরনের অর্থের প্রয়োজন তা বহন করার মত যথেষ্ট অর্থ এখন কোষাগাওে জমা আছে এখন শুধু বাকী আছে যথাযথ উদ্দ্যোগ গ্রহন করার।
এখানে উল্লেখ্য যে বিশ্বের প্রায় ৪০ টি দেশে মহাকাশ সংস্থা আছে এর অনেক দেশ বাংলাদেশের চেয়েও অনেক গরীব ও অনগ্রসর। তাছাড়া মহাকাশ সংস্থা করলে শুধু প্রাথমিক ব্যায়টাই করতে হবে, বিশ্বের অন্যান্য মহাকাশ সংস্থাগুলো থেকে যৌথ উদ্দ্যোগে ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করে অনেক ক্ষেত্রে সাবকন্ট্রাকিং করেও বিরাট পরিমান অর্থ উপার্জন করে এই সংস্থা পরিচালনা করা সম্ভব।
২০০৮ সনে বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে একটি Communication Satellite নির্মান ও তার উৎক্ষেপনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করা হয়। ২০০৯ সনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের উইং BTRC এর মাধ্যমে সরকার “বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ উপগ্রহ-১” নির্মান করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের কন্সালট্যান্ট নিয়োগ করার জন্য ২০১০ সনে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়। ঐ সময় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ঘোষনা দিয়েছিলেন, ২০১২ সনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু টেলিকমিউনিকেশন স্যাটেলাইট আকাশে উৎক্ষেপন করা হবে। তারপর দীর্ঘদিন পার হয়ে গেছে। বেসরকারী সূত্রে প্রকাশ ঐ স্যাটেলাইটের কনসালটেন্সি রিপোর্ট নাকি এখনও শেষ হয় নি। এটা হওয়ার পর স্যাটেলাইট নির্মান ও উৎক্ষেপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। যে কোন একটি মাঝারি ধরনের কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট নির্মান করতে কমপক্ষে আড়াই থেকে তিন বৎসর সময় লাগে তারপর উৎক্ষেপনের জন্য আরও কয়েকমাস। মোট কথা যেকোন কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট নির্মান থেকে উৎক্ষেপন পর্যন্ত মোটামুটি তিন বৎসর সময় ধরা হয়- সে আলোকে দেখা যাচ্ছে বর্তমান সরকারের মেয়াদে মাননীয় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর বাংলাদেশের স্যাটেলাইট আর আকাশে উৎক্ষেপন করা সম্ভব হচ্ছে না। আর ভবিষ্যতে কবে হবে তা এখন সম্পূর্ন অনিশ্চিত।
এখানে একটি বাস্তবতার অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে তাহলো কোন দেশেই টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রনালয় স্যাটেলাইট নির্মান বা উৎক্ষেপন করে না, এর জন্য একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থাকে যেগুলোকে বলা হয় মহাকাশ সংস্থা। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে National Aeronautics and Space Administration (NASA), ইউরোপে রয়েছে European Space Agency (ESA), জাপানে রয়েছে Japan Aerospace Exploration Agency (JAXA)ইত্যাদি। এই স্পেস এজেন্সিগুলো বা মহাকাশ সংস্থাগুলো সেই দেশের মহাকাশ গবেষণার যতরকম গবেষণা, স্যাটেলাইট নির্মান বা উৎক্ষেপন করার প্রয়োজন হয় সেই কাজগুলো সমাধা করে থাকে।
এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে ২০০৯ সনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে মহাকাশ গবেষণা কর্মকান্ড পরিচালনার লক্ষ্যে “বাংলাদেশ স্পেস এজেন্সি” গঠন করার জন্য একটি Project Profile পেশ করা হয়েছিল। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এই প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহন করেছিলেন এবং এর বাস্তবায়নের জন্য আশাবাদও ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সম্ভবত সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনিহার কারণে সেই প্রস্তাবটি এখন হিমাগারে চির নিদ্রায় শায়িত আছে।
“বাংলাদেশ স্পেস এজেন্সি” গঠন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য এখন অত্যন্ত অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে বাংলাদেশে যতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল আছে তারা প্রতি বৎসর প্রায় ১০০০ (এক হাজার) কোটি টাকার মত বিদেশের স্যাটেলাইটগুলোকে ভাড়া প্রদান করে থাকে। ইন্টারনেট ও টেলিফোনের জন্যও বিদেশী স্যাটেলাইটগুলোতে ১৫০০ কোটি টাকার মত ভাড়া প্রদান করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে Earth Observation Satellite, Weather Satellite, GPS ইত্যাদীতেও এক বিরাট পরিমান টাকা ভাড়া হিসেবে প্রদান করতে হচ্ছে। ওয়াকিবহাল সূত্রে প্রকাশ যে বাংলাদেশকে প্রতি বৎসর বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট বাবদ বিদেশী স্যাটেলাইট সংস্থাগুলোকে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা ভাড়া প্রদান করতে হচ্ছে এবং দিন দিন এই অংক আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ৩০০০ কোটি টাকা খরচ করলে একটি বড় ধরনের কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট নির্মান ও উৎক্ষেপন করা সম্ভব। অর্থাৎ বাংলাদেশ ১ বৎসরে ভাড়া বাবদ বিদেশী স্যাটেলাইট কোম্পানীগুলোকে যে পরিমান অর্থ প্রদান করে তা দিয়ে একটি- ৩০ টি ট্রান্সপন্ডার বিশিষ্ট বৃহৎ ধরনের নিজেস্ব স্যাটেলাইট বানানো সম্ভব। আর এই স্যাটেলাইট চালু হলে শুধু হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাই সাশ্রয়ই হবে না, বাংলাদেশের স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বিদেশী কোম্পানীগুলোকে ভাড়া দিয়ে বিরাট অংকের বৈদিশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
তাছাড়া বাংলাদেশে এখন প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক অগ্রসর হয়েছে। বিদেশী মহাকাশ সংস্থাগুলোতে সফটওয়্যার ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেও বিরাট অংশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র তৈরি হবে। এখানে উল্লেখ্য ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ইত্যাদি উন্নত দেশগুলোতে শুধুমাত্র স্যাটেলাইটের মূল অংশটুকুন বানানো হয় কিন্তু এর বিভিন্ন স্পেয়ার পার্টস্ বা উপাদানগুলো ভারত, চীন, কোরিয়, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশে যেহেতু সস্তা শ্রম পাওয়া যাচ্ছে এবং আগামী বহু বৎসর ধরে তুলনামূলক ভাবে সস্তা শ্রম পাওয়া যাবে তাই স্যাটেলাইটের হার্ডওয়্যার, সফটওয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপাদানগুলো ব্যাপকভাবে উৎপাদন করে গার্মেন্ট সেক্টরের মত একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে আর বিশাল অংকের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া দিন দিন স্যাটেলাইটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং এর ব্যবহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে সুতরাং “বাংলাদেশ স্পেস এজেন্সি” গঠন করলে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে শুধু উন্নত জাতি হিসাবেই পরিচিত হবেনা এই ক্ষেত্রটি লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান ও ব্যবসা বানিজ্যের এক অপার সুযোগের দ্বার উম্মোচন করবে।
আমাদের শুধু বর্তমান নিয়ে ভাবলে চলবেনা ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করতে হবে। আগামী ২০-৩০ বৎসরের মধ্যে মহাকাশ প্রযুক্তি আমাদের দৈনিন্দিন জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে আর এটি একটি বিশাল শিল্পে পরিণত হবে। তাই সম্ভাবনাময় এই ক্ষেত্রটিকে আর সময় অপচয় না করে মহাকাশ শিক্ষা, প্রযুক্তি ও প্রয়োগের উন্নয়নের জন্য অনতিবিলম্বে ‘বাংলাদেশ স্পেস এজেন্সি’ গঠন ও তার কার্যক্রম শুরু জন্য বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবতার আলোকে চিন্তাভাবনা ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
এফ, আর, সরকার
জেনারাল সেক্রেটারী
বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসইটি